ভ্রমণের বেলায় আগে থেকে পরিকল্পনা থাকলে সবকিছু ঠিকঠাক করা যায়। তাই চার-পাঁচ মাস আগেই ভারতের সিকিম ও দার্জিলিংয়ে আটদিন বেড়ানোর পরিকল্পনা করেছিলাম। আমরা সাতজন মিলে ভালোভাবেই ঘুরে এলাম। শুনে হয়তো অবাক হবেন, এই ভ্রমণে আমাদের মাথাপিছু খরচ হয়েছে ১০ হাজার টাকা!
ভারতে প্রবেশের পর কাস্টমসের বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর দিয়ে বেরিয়ে এলাম। প্রয়োজনীয় কাজ শেষে আমরা টাকার বিনিময়ে রুপি নিলাম। সীমান্তেই টাকা থেকে রূপি একচেঞ্জ করে নেওয়া ভালো। কারণ শিলিগুড়ি বা গ্যাংটকে একচেঞ্জ রেট কম। সীমান্ত থেকে অটোতে চড়ে গেলাম বাইপাস। এরপর এনবিএসটিসি বাসে চড়ে সোজা শিলিগুড়ির এসএনটি (সিকিম ন্যাশনাল ট্রান্সপোর্টেশন)। শিলিগুড়ি জংশনের পাশেই এসএনটি। রাস্তায় প্রচুর জ্যাম থাকায় তিন ঘণ্টার পথ যেতে লেগেছে প্রায় পাঁচ ঘণ্টা। শিলিগুড়ি নেমে দ্রুত দুপুরের খাবার খেয়ে নিলাম।
” title=””>ঘড়িতে বাজে বিকাল ৪টা। ভাগাভাগি করে যাওয়ার কোনও জিপ পাচ্ছিলাম না। রিজার্ভ জিপের ভাড়া আকাশচুম্বি! এদিকে আমাদের কাছে ট্রাভেল প্যাকেজ বিক্রির জন্য শিলিগুড়ির ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর মধ্যে টানাহ্যাঁচড়া শুরু হয়ে গেলো। কম খরচে ঘুরতে চাইলে কোনও এজেন্সির প্যাকেজ না নেওয়াই ভালো। ২ হাজার ৫০০ রুপিতে একটি জিপ ভাড়া পেলাম। গ্যাংটক পৌঁছাতে বেজে গেলো রাত ৯টা। সেখানে দ্রুত হোটেল ম্যানেজ করতে পেরেছি। গ্যাংটক যাওয়ার আগে রাংপোতে এন্টি সিল নিলাম। দলের সবার পাসপোর্ট একজন নিয়ে গেলেই এন্ট্রি করে দেয় রাংপোতে। তবে যদি মনে করেন শিলিগুড়ি থেকে অনুমতি না নিয়ে রাংপো থেকে নেবেন, সেটাও সম্ভব।
সাঙ্গু ল্যাকের প্যাকেজ খুঁজতে পরদিন সকালে বেরিয়ে পড়লাম। কিন্তু ভাগ্য খারাপ, সব ট্রাভেল এজেন্সি বন্ধ ছিল। সিকিম ও দার্জিলিংয়ে রাত ৮টার পর কিছু খোলা পাওয়া যায় না। তবে শিলিগুড়িতে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত আমরা সব খোলা পেয়েছি।
পরদিন ভোর ৬টায় সাঙ্গু ল্যাকের প্যাকেজ পেলাম ৩ হাজার ৫০০ রুপিতে। সাঙ্গুর উদ্দেশে রওনা দিলাম সকাল ১০টায়। মাঝপথে ভাড়ায় মিলবে জুতা ও জ্যাকেট। এগুলা ছাড়া কোনোভাবেই যাওয়া ঠিক হবে না। সাঙ্গু পার হওয়ার পরও আমাদের ড্রাইভার গাড়ি থামাচ্ছিল না। জিজ্ঞেস করে জানতে পারি, তিনি বাবা মন্দির নিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তো শুনে অনেক খুশি! কারণ বাবা মন্দিরে যাওয়ার অনুমতি নেই বাংলাদেশিদের। ড্রাইভার সম্ভবত ভেবেছে আমরা ভারতীয়। আমাদের সঙ্গে কোন গাইড যায়নি। মনে হলো বাংলাদেশ থেকে বোধহয় আমরাই প্রথম বাবা মন্দির ঘুরে আসছি। এখন পর্যন্ত বাবা মন্দিরের ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলাদেশি কারও পোস্টে চোখে পড়েনি। তবে এই ঝুঁকি নিয়ে কেউ বাবা মন্দিরের দিকে পা বাড়াবেন না। রাস্তায় ধরা খেলে সাতজনের জরিমানা হতো ৩৫ হাজার রুপি।
সাঙ্গু অনেক সুন্দর। আমাদের ভাগ্য বলতে হবে, বাবা মন্দির ও সাঙ্গু লেকে ভালোই তুষার পেয়েছি। সবার শখ ছিল এটা দেখার। বিকাল ৪টার মধ্যে গ্যাংটক ফিরে আসি। এরপর শুরু হয় মুসলিম হোটেলের সন্ধান। লাল মার্কেট দিয়ে একটু সামনে গেলে মিলবে জান্নাত হোটেল ও আসলাম বিরিয়ানি। আমরা প্রতি বেলা আসলাম বিরিয়ানিতে খেয়েছি। খাবারের মান খুব ভালো, দামও খুব বেশি মনে হয়নি।
খেয়েই পরের দিনের জন্য নর্থ সিকিমের প্যাকেজ কিনতে বেরিয়ে পড়ি। কারণ আমরা বিকাল ৫টায় ছবি দেখবো লালবাজারের সিনেমা হলে। সেখানে চলছিল জন আব্রাহামের ‘রোমিও আকবর ওয়াল্টার’। আমরা অনেক এজেন্সির সঙ্গে কথা বলে দেখলাম— পরের দিনের প্যাকেজ দিতে কেউ রাজি হচ্ছে, আবার কেউ রাজি হচ্ছে না। কারণ এর একদিন পর (১১ এপ্রিল) ছিল সিকিমের নির্বাচন। তাই গাড়ি রাজি হচ্ছিল না যেতে। আবার গেলেও ভাড়া অনেক বেশি বলছিল। অবশেষে সানফ্লাওয়ার এজেন্সিতে গিয়ে নর্থ সিকিমের প্যাকেজ মিললো। একরাত দুই দিনের জন্য সবকিছু মিলিয়ে খরচ ১২ হাজার রুপি। সব কাগজপত্র জমা দিয়ে ছবি দেখে ডোমিনজের পিৎজা খেয়ে হোটেল রুমে ফিরি আমরা।
১০ এপ্রিল সকাল ১০টায় নর্থ সিকিমের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হয় আমাদের। আগে থেকেই জানতাম, নির্বাচনের কারণে গাড়ি যেতে চাচ্ছে না। এ কারণে আমাদের কপালে পড়লো একটা নাজুক গাড়ি। এ নিয়ে দলের সবাই অসন্তুষ্ট। প্যাকেজে একহাজার রুপি বেশি দিয়ে হলেও জাইলো দিয়ে যাওয়া ভালো। এই পথেও আমাদের সঙ্গে কোনও গাইড যায়নি। ড্রাইভারই নাকি সব চেনে। রাস্তায় বিভিন্ন স্পট দেখে লাচুং পৌঁছালাম রাত ৮টায়। মাঝপথে গাড়ির চাকা বিগড়ে গিয়েছিল, এ কারণে এত দেরি হলো। দুপুর ও রাতের খাবার যথেষ্ট ভালো ছিল। লাচুংয়ে হোটেল দেখে আমাদের মধ্যে প্রশান্তি এলো। এটি তিন তারকা মানের মনে হলো। নতুন একটি হোটেল। গাড়ি নিয়ে অসন্তুষ্টি থাকলেও ভালো মানের হোটেল ও খাবারের সুবাদে তা উড়ে গেলো।
সকালে ঘুম থেকে উঠে জানা গেলো, ইয়ামথাংয়ের রাস্তা বন্ধ। অথচ ওই পথ দিয়েই যেতে হয় জিরো পয়েন্ট। তাই ইয়ামথাংয়ের পরিবর্তে তিন হাজার রুপি বাড়তি দিয়ে আমরা চলে গেলাম কাটাও। এর সৌন্দর্য সত্যি বলতে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। সেখানে গেলে মনে হবে কাশ্মীরে আছেন বুঝি! তবে আমাদের ৮ কিলোমিটার আগেই নামিয়ে দেওয়া হয়। বাকিটা পথ বরফের ওপর ট্র্যাক করতে হয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী, কাটাও সকাল ৯টার মধ্যে ঘুরে আসতে হবে। এরপর আর সেখানে ঢোকার অনুমতি মেলে না।
কাটাও থেকে ফিরে ইয়ামথাং ভ্যালির উদ্দেশে রওনা হলাম আমরা। কিন্তু সেখান থেকে ১৩ কিলোমিটার আগেই রাস্তা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কারণ রাস্তা ভেঙে পড়েছে। যদিও বিকল্প রাস্তার নির্মাণ কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে দেখেছি। যতদূর সম্ভব আমরা ঘুরেছি। দুপুরের ১২টার মধ্যে ফিরে গোসল সেরে খেয়ে গ্যাংটকের উদ্দেশে রওনা দিলাম। রাত ৯টায় মাঝপথে গাড়ি বিকল হয়ে পড়ে। এ কারণে প্রায় দুই ঘণ্টা রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এজেন্সি গাড়ি পাঠানোর পর আমরা ফিরতে পারি। নির্বাচন থাকায় গাড়ির সংকট ছিল খুব। যে হোটেলে আগে ছিলাম সেখানেই গিয়ে উঠি। ভাগ্য ভালো এমজি মার্কেটের একটু নিচে নন-ভেজ একটা হোটেল পেয়েছিলাম। এত রাতে সাধারণত হোটেল খোলা থাকে না।
গ্যাংটক থেকে দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে রওনা হলাম ১২ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৭টায়। ভাগাভাগি করে জিপ পাওয়ায় জনপ্রতি লেগেছে ৩০০ টাকা। মনে করে রাংপোতে নেমে সিলের কাজ সেরে নিতে হবে। দুপুরে দ্রুত মল রোডের পাশে হোটেল বুক করলাম। সেদিন সবার শপিং শেষ হলো। পরদিন সকালে মিক্সড স্পট উইথ রক গার্ডেন ও বাতাসিয়া লুপ দেখতে বেরিয়ে পড়ি। দুপুরে খাওয়া শেষে শুরু হয় শিলিগুড়ির উদ্দেশে যাত্রা। ফিরত বিকাল হয়ে যায় আমাদের। দ্রুত কেনাকাটা শেষ করে রাতে সেখানে থাকলাম। চেংড়াবান্ধা দিয়ে ১৫ এপ্রিল সকালে ঢাকায় ফিরে এলাম। আটদিনের ট্যুরে জনপ্রতি সব মিলিয়ে খরচ হলো ১০ হাজার ২২৩ টাকা।
জেনে রাখা ভালো
সিকিম যাওয়ার আগে ১০ কপি করে পাসপোর্ট, ভিসা ও পাসপোর্ট সাইজের ছবি নিতে হবে। রাংপোতে আসা-যাওয়ার পথে সিল অ্যারাইভ ও ডিপারচার করিয়ে নিন। নয়তো পরবর্তী সময়ে ভিসা পেতে সমস্যা হবে। অন্যদের সঙ্গে ভাগাভাগি করে জিপে যাতায়াতের সময় অবশ্যই বলে নেবেন, রাংপোতে কিছু সময় দাঁড়াতে হবে। যদি একসঙ্গে সিকিম ও দার্জিলিং ট্যুরের পরিকল্পনা থাকে তাহলে আগে দার্জিলিং ঘুরবেন। নর্থ সিকিমে বেড়ানোর আগে সাঙ্গু লেক ঘুরে আসুন। গোছানো ও পরিছন্ন সিকিমে প্রকাশ্যে ধূমপান ও মদ্যপান নিষেধ। এমন কাজে ধরা পড়লে ৫ হাজার রুপি জরিমানা গুনতে হবে। শিলিগুড়ি ও দার্জিলিংয়ে দালালের চক্কর থেকে সাবধান। রাস্তায় কোনও প্লাস্টিক বা অপচনশীল কিছু ফেললে মোটা অঙ্কের টাকা জরিমানা দিতে হবে।
বিডিটাইমস৩৬৫ডটকম/